ভূমি জরিপের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ

ভূমি জরিপ ইতিহাস

বিভিন্ন ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন যে, এক সময় মানুষ যখন যাবাবরের মত বন জঙ্গলে বসবাস করতে ও পশু পাখির শিকার ও ফলমূল আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করত । বর্তমান সময়ের মত বসবাস কিংবা ভূমির ব্যবহার তারা জানত না। কালক্রমে যখন বনজঙ্গলে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিল তখন থেকে তারা বিকল্প খাদ্যের সমাধানে কৃষি কাজের দিকে আস্তে আস্তে ঝুকে পড়ল। তখন থেকে মানুষ দলবন্ধ ভাবে বসবাস করা শুরু করে। তারা এক সময় নদী তীরবর্তী পলিময় উর্ভর ভূমি যেমন মিশরের নীলনদের তীরবর্তী অঞ্চল, ইরাকের টাইগ্রীস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরবর্তী অঞ্চল, চীনের ইয়াংসিকিয়াং ও হোয়াংহো নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ভারতীয় উপমহাদেরেশর গংঙ্গা ও সিন্ধু নদের অববাহিকায় কৃষি বিপ্লবের সূচনা ঘটে এবং কৃষি ভিত্তিক সভ্য সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। জীবন জীবিকা অর্জনের এ আদি ও একমাত্র উৎসের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং জমি জমার সীমানা নির্ধারন করে মালিকনা চিহিৃত করার চিন্তা এক সময় মানুষের মাথায় আসে। এভাবে ভূমি মালিকানার ধারনা হইতে ক্রমে ভুমি জরিপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

আমাদের উপমহাদেশে ভূমি জরিপের ইতিহাস খুজঁতে গেলে দেখা যায় তার ইতিহাস খুব একটা প্রাচীন নয়। এদেশে ভূমি জরিপের প্রথম কাজটি করেন সিকান্দার শাহ ১৩৫৮-৫৯ সালের মধ্যে

এরপর ভূমি সংস্কার ও ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পাঠান সম্রাট শেরশাহের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। শেরশাহ আবাদী ভূমি জরিপ করার জন্য আমিন নিয়োগ করেন এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য কানুনগো নিয়োগ করেন। তিনি ১৫৪০-৪৫ সনের মধ্যে মাত্র ৫ বছরে ভূমি জরিপ কাজ সম্পন্ন করেন। ভূমি ব্যবস্থাপনায় তাঁর আমলের উদ্ভাবিত ভূমি রেকর্ড প্রস্তুতের ঐতিহাসিক পদ্ধতি এখনো অব্যাহত রয়েছে।

এরপর মুঘল আমলে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান, মীর জুমলা ও মুর্শীদকুলী খার আমলে বর্তমান বাংলাদেশে আবাদী জমির জরিপ করে নকশা ও রেকর্ড প্রস্তুত করার জন্য আমিন ও কানুনগো নিয়োগ করা হত। ‍মুলত উক্ত জরিপগুলো ছিল বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের একটি নমুনা জরিপ। তখনকার জরিপ বর্তমানের মত বিজ্ঞান ভিত্তিক জরিপ ছিল না।

এরপর ১৭৫৭ সালের ২৩জুন প্রহসন মূলক যুদ্ধে ইংরেজদের নিকট বাংলার স্বাধনিতা হারানোর পর কোম্পানী আমলে বিখ্যাত ইংরেজ নকশাবিদ মেজর জন রেনেল ১৭৬৩-৮২ সনের মধ্যে এ দেশে জরিপ কাজ পরিচালনা করেন। তিনিই প্রথম কিছুটা শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতিতে একটি জরিপ কার্য চালান। এজন্য তাকে ভারতীয় জরিপ বিজ্ঞানের পিতৃ পুরুষ বলা হয়।

এরপর ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর ফলে কৃষক রায়তদের ভূমির মালিকানা জমিদাদের হাতে চলে যাওয়ার পর জমিদাদের মধ্যে মহাল/পরগণার সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ নিরসন করার প্রচেষ্টায় ১৮৪৬-৭১ সালের মধ্যে “থাকবাষ্ট জরিপ” নামে একটি জরিপ কার্য পরিচালনা করা হয়। আর সমসাময়িক কালে আরেকটি রাজস্ব জরিপ পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৮৪৭-৭৮ সাল পর্যন্ত রেভিনিউ সার্ভে করে যে সকলে এষ্টেট বা মহাল স্থায়ীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল তা অনেকটা নির্ভূল ছিল অর্থাৎ বিজ্ঞান ভিত্তিক জরিপ ছিল।

এরপর ১৮৫৭ সালে অধিকার হারা শোষিত বঞ্চিত কৃষক জনতার স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে তৎকালীন ইংল্যান্ডের রানীর সরকার ১৮৫৮ সালে ক্ষমতা নিয়ে ১৮৫৯ সালে বৃটিশ সরকার Rent Act-1859 জারি করে জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে সু-সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। এ আইন কৃষকদের কিছুটা হলেও উপকারে আসে।

এরপর তদানীস্তন পূর্ব বঙ্গ প্রদেশের জন্য অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের ভূমি জরিপের উদ্দেশ্যে প্রথম ১৮৫৭ সালে সার্ভে আইন এবং ১৮৮৫সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হয়। উক্ত আইন দুটি পাশ হবার ফলেই ভূমি জরিপ আইনগত ও বিজ্ঞান ভিত্তিক কার্যক্রম হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।

সিভিল ল ফাউন্ডেশন-আইনের ক্ষুদ্রাংশ ৩য় খন্ড, (অ্যাডভোকেট জিয়াউর রহমান (স্যার))

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *